প্রতিবাদ ও ভালোবাসা
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
(প্রিয় পাঠকগণ গল্পটি যদি বাস্তবতার সাথে কল্পনা প্রসূত গল্পের সাদৃশ্য পান তাহলে আশা করি শেয়ার করবেন, কেননা সাহিত্য জীবনের দর্পন।)
-------------------------------------------------------------------
সকালের নাস্তা টেবিলে। মা সোহাগী আর মেয়ে সুমিতা বসে নাস্তা করছে। বাবা কদম আলী নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত। সেই কাক ডাকা ভোরে কদম আলী বের হোন আবার গভীর রাতে ফিরেন।
মেয়ে সুমিতা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ করছে। সপ্তম সেমিস্টার চলছে। মা সোহাগী মহিলাদের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত। মাঝে মাঝে নিজেই টাকা পয়সা খরচ করে সমাজ সেবার নামে বিভিন্ন সংগঠন থেকে পুরষ্কার ডাগিয়ে আনেন। এটা সোহাগী একা করেন না, বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি বিদ্যমান এবং হঠাৎ ফুলে ফেঁপে উঠা সমাজ খুব ভালো ভাবেই এটা ম্যানেজ করে।
খাবার টেবিলে বসেই মেয়ে সুমিতা মার সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। কারণ এই খাবার টেবিল ছাড়া ব্যস্ত মা বাবাকে সুমিতা আর ফ্রি পায় না। তাই নাস্তা সময়টা সুমিতা সময় নিয়ে করে।
সুমিতা বেশ সচেতন এবং দেশ প্রমিক, অন্যায় এবং অনাচার তাঁর মেনে নিতে কষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুদের অনিয়ম খুব ভালো করে ধরিয়ে দেয়। দেশের কারেন্ট বিষয় নিয়ে বন্ধুদের সাথে তর্ক বিতর্ক করে। ভালো কে ভালো এবং খারাপ কে খারাপ বলতে সুমিতার একটুও ভাবতে হয় না।
বাবা সাংসদ হলেও ক্ষমতাসীনদের ভুল ভ্রান্তি নিয়ে কথা বলতে একটুও চিন্তা করে না। গনতন্ত্র, উন্নয়ন আর জনগণের অধিকার নিয়ে বেশ সচেতন। অন্যায়, জুলুম, সন্ত্রাস আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুমিতার অবস্থান সুদৃঢ়। এর জন্য বন্ধু মহলে সুমিতা "প্রতিবাদী কন্যা" উপাধিতে ভূষিত।
আজ নাস্তার টেবিলে সুমিতা একটু গম্ভীর এবং নিশ্চুপ। মায়ের কাছে ব্যাপারটা বেশ বেমানান মনে হচ্ছে। যে মেয়ে খাবার এর চেয়ে কথা বলে বেশী, যে মেয়ে মায়ের দোষ নিয়ে প্রতিবাদে মুখর, সে হঠাৎ চুপ কেন? সোহাগী বেগম বেশ ভাবছেন আর অপেক্ষা করছেন কখন সুমিতা কথা বলা শুরু করে।
না কোন কথা বলছে না, আপন মনে বেশ সময় নিয়ে পারুটিতে জেলী আর পনির মাখছে। ছুরিটা নিয়ে এপাশ ওপাশ করছে কিন্তু মুখে দিচ্ছে না।
: সুমিতা তুমি কথা বলছো না যে?
: ভাবছি মা।
: কি নিয়ে এতো ভাবছো
: ভাবছি কি ভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যায়।
: তোমার এতো ভাববার দরকার নেই । নিজের পড়া লেখা নিয়ে ভাবলেই হবে।
: মা ভুল বললে। যেহেতু লেখা পড়া করছি, শিক্ষিত হচ্ছি, সেহেতু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা দায়িত্ববোধের অংশ। তানাহলে শিক্ষা অর্জনটা নেহায়েত সনদ প্রাপ্তির নামান্তর মাত্র মা।
: চতুর্দিকে অন্যায় আর অনিয়ম! তুই কয়টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবি।
: মা ভাবছি ঘর থেকে শুরু করবো।
: মানে?
: মানে খুব সোজা, তোমার এবং বাবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দিয়ে শুরু করবো।
: আমি আবার কই অন্যায় করলাম?
: এই যে বিভিন্ন সংগঠনের নামে সরকার এর কাছ থেকে টাকা ভাগিয়ে লুট করো আর বছর শেষে টাকা পয়সা খরচ করে এ্যাওয়ার্ড নাও, এটা কি খুব মহৎ কাজ মা??
: তুই তো দেখছি দুধ কলা দিয়ে পোষা কাল সাপ!!
: না মা, আমি তোমাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়েত এর মাধ্যম।
: তোর বাবাকে তো চিনিছ, উল্টা পাল্টা কিছু করলে কিন্তু মেরে ফেলবে।
: জানি, যার রাজনৈতিক জীবনটাই বিতর্ক আর রহস্যের ভরপুর, তার পক্ষে সব করা সম্ভব।
: তা তোর মতলবটা কি শুনি!
: মা কিছুদিন আগে ফেসবুকে দেখলাম এক ছেলে তার বাবাকে ভোট দিতে তার এলাকার লোকজনকে বারণ করছেন।
: কেন?
: কারণ বাবা একজর বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও স্বাধীনতা বিরোধী দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে নির্বাচন করছেন।
: ঠিকই তো করছে
: হ্যাঁ আমিও বলি ঠিক করছে এবং আমারও ঠিক কাজটাই করা উচিৎ।
: তুই কি বেঠিক করছি যে এখন ঠিক কাজ করতে হবে?
: আচ্ছা মা, স্বাধীনতা বিরোধীরা তো দেশের শত্রু? স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিরোধীতা করে দেশের জনগণের উপর নির্মম অত্যাচার, খুন আর মা বোনের ইজ্জত হরণে সহায়তা করেছিলো। এদেরকে এবং এদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল শামসদের আমরা ঘৃণা করি এবং এদের অপকর্মের শান্তি চেয়ে সদা সোচ্চার এবং জাগ্রত থাকি। সর্বস্তরের জনগণের আন্দোলনের মুখে এদের বিচার কার্যও চলমান।
: হ্যাঁ। স্বাধীনতা বিরোধী দল গুলো এখনও দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
: আচ্ছা মা, মনে করো আগামী কোন এক নির্বাচনে ঐ স্বাধীনতা বিরোধী পক্ষ দেশের ক্ষমতা পেয়ে গেল, তাহলে দেশ কি পাকিস্তান হয়ে যাবে? বা স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় থাকলে কি দেশ ভারত হয়ে যাবে? এইসব কথা হলো রাজনৈতিক মিথ্যাচার। বুদ্ধিমান লোকের নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই না মা।
: তা তোর পরিকল্পনা টা কি?
: স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা বিরোধীতা করেছে তারা যেমন দেশের শত্রু এবং দেশের ভালো চায় না বলে বিশ্বাস করি, ঠিক তেমনি করে স্বাধীন বাংলাদেশে যারা ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে দেশের টাকা মেরে খেয়ে দিচ্ছে তারা কি দেশ প্রেমিক? সন্ত্রাসী, খুনী, শেয়ার বাজার লুটে খাওয়া গোষ্ঠী, দুর্নীতিবাজ, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ এবং জনগণের নিরাপত্তা ও অধিকার হরণ কারীরা কি দেশ প্রেমিক? গনতন্ত্র জনগণের অধিকার এটা যদি স্বাভাবিকতা হারিয়ে সন্দেহ আর অনিশ্চয়তার দোলায় দোলে সেটা কি মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে যায় না মা?
: হ্যাঁ যায় তো। তোর কথা গুলোও ঠিক। কিন্ত সব কিছু দেখে চুপ থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ দলে থাকা ভালো।
: না মা, ভুল বললে, সব কিছু দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা লালন করে অন্যায় কে অন্যায় বলাই হলো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ। এর ব্যতিক্রম হলে বুঝতে হবে সেখানে ব্যক্তি স্বার্থ আর শোষণের মানসিকতা বিদ্যমান।
: তোর এতো পাকনা কথা বলা দরকার নাই। যেমন আছিস তেমনি থাক, তোর বাবার বিরুদ্ধে একটা কথা বললে স্রেফ মেরে ফেলবে।
: বাবার যা কুকীর্তির ইতিহাস মানুষ এর মুখে শোনে বড় হচ্ছি তাতে বেড়ে উঠছি ঠিক, মনের আনন্দ বা তৃপ্তি কখনো পাচ্ছি না। রাস্তায় যখন মিছিল দেখি "কদম আলী খুনির বিচার চাই" তখন তাঁর মেয়ে হিসেবে মরে যেতে ইচ্ছে করে। যখন বন্ধুরা বলে কীরে তোর বাবা নাকি ব্যাংক খেয়ে ফেলছে তখন লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায় মা। এর চেয়ে "বাবার হাতে কন্যা খুন" বড় হেড লাইন নিউজ হয়ে ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে নাম লেখানো অনেক সম্মানের।
: তুই কি করতে চাছ।
: আমি বাবার কুকীর্তি ও দীর্ঘ দিনের অপকর্ম নিয়ে একটা ভিডিও বানিয়েছি আর সাথে বাবাকে ভোট না দিতে বলে মানুষের কাছে আকুতি জানিয়েছি।
: সাবধান এসবে যাবি না। তোর বাবা সোজা গুলি করবে। বাসা থেকে বের করে দিয়ে লাশ বানিয়ে কবরে পাঠিয়ে দিবে।
: আমি সেটাই চাচ্ছি মা। মানুষ দেখুক তারা যাকে ভোট দিতে চায় সে কতোটা ভালো মানুষ!
: তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? কে কি ফেসবুকে দিলো আর তা দেখে তুইও উঠে পড়ে লাগছিস নিজ বাবা সম্পর্কে নেগেটিভ প্রচার করতে!
: আচ্ছা মা, তুমি তো বলতে বিয়ের পর অর্নামেন্ট বলতে ছিলো নানার দেয়া তিন ভরি স্বর্ণ। আর এখন তোমার স্বর্ণ ব্যাংকের ভোল্টে রাখতে হয়! কতো ভরি যেন মা? একশত ভরির বেশী! এইসব কেনার টাকা কোথা থেকে কীভাবে এসেছে কখনও জানতে চেয়েছো?
:এসব জানার কি আছে? জন প্রতিনিধিদের টাকা এমনিই আসে।
: মা দুই রুমের ভাড়া বাসা থেকে আজ ডুপ্লেস বাড়ি, অনেক গুলো এ্যাপার্টমেন্ট, মার্কেট কোথা থেকে এলো? কখনও জানতে ইচ্ছে করেনি!
: এসব তোর বাবা উপার্জিত টাকা দিয়ে কিনেছে।
: হা হা হাহাহা। জীবনে বাবাকে ব্যবসা করতে দেখলাম না, চাকরি করেছে শুনিনি, দাদাজানেরও কোন ব্যবসা ছিলো না। দেশে একটা বসত বাড়ি ছাড়া কিছু নেই, তা হলে উপার্জনের মাধ্যমটা কি মা?
:তোর বাবার ঠিকাদার লাইসেন্স আছে, ও দিয়ে ব্যবসা করে।
: হমমম, আমার এক বন্ধু আমাকে সব সময়ই জিজ্ঞেস করে "কি রে তোর টেন্ডারবাজ বাবা কেমন আছে?" আমি নীরবে এড়িয়ে যাই।
: নিশ্চয়ই ঐ ছেলে তোর বাবার বিপক্ষ দলের কেউ।
: উচিত আর সত্য বললে বীর মুক্তিযোদ্ধাও বিপক্ষ আর স্বাধীনতা বিরোধী হয়ে যায় মা!
: তানাহলে তোকে ওভাবে বলবে কেন?
: কেন বলবে না! যার বাবা খুনের দায়ে জেল খাটে, জেল থেকে বের হয়ে সন্ত্রাসী আর মাস্তানির মাধ্যমে চাঁদাবাজি করে হঠাৎ টাকাওয়ালা হয়ে যায়, যে সন্ত্রাসী শক্তির বৌদলতে হঠাৎ নেতা বনে যায় এবং সুযোগ সুবিধা মতো সাংসদও হয়, তাকে কে ভালো বলবে? হ্যাঁ বলে, যারা তার মতো এবং নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে বাবাকে লাগে তারা ভালো বলবে।
: তুই মানসিক ভাবে অসুস্থ, তৈর বাবা আসলে বলতে হবে, তোকে যেন মানসিক ডাক্তার দেখানো হয়। এই দেশে না বিদেশে গিয়ে যেন দেখায়। এদেশে দেখালে আবার পত্রিকার হেডিং হয়ে যাবে।
: মা শুনেছি বাবা তোমাকেও তুলে এনে জোড় করে বিয়ে করেছে, আর তাই নানা বাড়ির কেউ বাবার সাথে সম্পর্ক রাখে না।
: কে বলছে? আমি তোর বাবার সাথে প্রেম করে বিয়ে করেছি। তোর নানা মামারা স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে হাত মিলিয়ে বিপক্ষ রাজনীতি করে বলে তোর বাবাকে দেখতে পারে না।
: মা, "যা রটে, তা কিছুটা বটে"। আমার বাবা স্বার্থ ছাড়া কারো সাথে মিলে না। আচ্ছা মা, বাবা প্রতিমাসে বেশ কিছু জায়গায় মোটা অংকের টাকা পাঠায়, সবাই বলে এই টাকা দিয়ে বাবা সবার মুখ আর চোখ বন্ধ রাখে।
এমন সময় সুমিতার ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে দিকে তাকায়। সুহাস ফোন করেছে। সুহাস একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলে এবং সুমিতার বয় ফ্রেন্ড। এই ভিডিও টা বানাতে সুহাস ট্যানিক্যাল সাপোর্ট দিয়েছে।
: মা সরি, ফোনটা একটু ধরি।
: হুমমম ধর।
: হ্যালো সুহাস (খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে সোফাতে বসে কথা বলে। সোফা আর খাবার টেবিলের দুরত্ব এতো বেশি যে আস্তে কথা বললে শোনা যাবে না।)
: সুমিতা কাজটা ডান এবং তোমার ফেসবুক টাইম লাইনে আপলোডেড। মাত্র দশ মিনিটে দশ হাজার ভিউ, কয়েক শতো কমেন্ট এবং অসংখ্য শেয়ার।
: দারুণ । তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। তুমি আমার না দেশের মানুষের জন্য একটু ছোট্ট পরিসরে মুক্তিযুদ্ধ করে ফেললে।
: কারণ আমি যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমার রক্ত প্রবাহে।
: আচ্ছা শোনো, আপাতত আমাকে আর ফোন টোন দিও না। ফেসবুকে ফলোআপে রেখো। জানি না বাবা কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে। আমি কি নানু বাড়ি চলে যাবো কিনা ভাবছি?
: কিন্ত আমার ভয় হচ্ছে, তোমার বাবা না রেগে কি তোমাকে অত্যাচার করে।
: আরে করলে করবে। মরেই তো আছি, আর কি মারবে।
: আমি তোমাকে ভালবাসি, খুব ভালোবাসি 💚
: হুমম জানি, আর তাই তো পাসওয়ার্ডটা দিয়েছি। তোমাতে বিশ্বাস আমার পাহাড়ের মতো অটল।
: তোমার বাবা সম্পর্কে যা বলেছো, তাতে আমার খুব চিন্তা হচ্ছে, পাছে না আবার আমাকে গুম করে দেয়।
: সুহাস ভিডিও টা আমি আপলোড করেছি তুমি নও। এবং আমি মরে গেলেও তোমার নাম বলবো না । এতোটুকু বিশ্বাস রেখো।
: ওকে। আমার মনে হয় তোমাকে অন্যত্র নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়া ভালো।
: হুমম নানু বাসায় চলে গেলে নিরাপদ। ওদিকে বাবা আসবে না।
ফোনটা রেখে আবার খাবার টেবিলে আসে। বসে পানি পান করে। চা বানিয়ে নেয়।
: কে ফোন করেছিল?
: মা আমার এক বান্ধবী। একটু সমস্যায় আছে, একটা চাকরির জন্য বাবার সুপারিশ চায় আর আমাকে একটু হেল্প করতে বলে।
: তা সমস্যা কি করে দাও।
: হুম বলেছি করে দিবো। বাবা আসলে আজ বলবো।
সুমিতা একটু চালাকি করলো। নানু বাড়ি যাবার একটা নির্ঝঞ্জাল ব্যবস্থা চায়, সেটা করা এবং দ্রুত বাসা থেকে বের হওয়া। এই মুহূর্তে পথ খুঁজছে।
: কিরে কি ভাবছি?
: মা আমার না বাবার এই নির্বাচন, বাসা ভর্তি কিছু অদ্ভুত লোকের আনাগোনা, ধর্ষণের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে কামড় দেয়া মানুষ গুলো অসয্য লাগে। তাই ভাবছি নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নানু বাসায় থাকবো।
: তা যেতে পারিছ । তোর নানা ভীষণ খুশী হবে।
: হুমম। তুমি ড্রাইভার কে বলে দাও। আমি এখনি যাবো।
:*ওকে বলে দিচ্ছি।
সোহাগী বেগম স্বামীর জন্য ভোট চাইতে বের হবেন। মহিলা নেত্রীরা বসে আছেন। নিজে সাজ গুঁজ করছেন। দামী পারফিউম স্প্রে করলেন, ভোটের কথা মাথায় রেখে সৌদি থেকে হানা হিজাবটাও সুন্দর করে বেঁধেছেন। হঠাৎ ফোনে রিং । বিছানায় পড়ে থাকা ফোনটার দিকে তাকালেন। স্বামীর নাম ভাসছে। ঝটপট এসে ফোন ধরেন।
: হ্যালো
: তোমার মেয়ে কোথায়? আমার নামে ফেসবুকে এইসব কি দিছে? ওকে আমি গুলি করে মারবো।
: আরে কি দিছে সেটা আগে বলবে তো!
: তোমার মেয়ে আমাকে দেশের শত্রু বানিয়ে সবাইকে ভোট দিতে বারণ করেছে। আমি নাকি খুনী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ব্যাংকের টাকা মেরে খাই, শেয়ার বাজারের বারোটা বাজিয়েছি, আমরা দেশের শত্রু! সবাইকে অনুরোধ করেছে যেন স্বাধীনতা বিরোধীদের মত স্বাধীন দেশের শত্রুদেরও ভোট না দেয়। এও বলেছে, "আমি তাঁর মেয়ে হিসেবে আপনাদের অনুরোধ করছি, বাবাকে ভোট দিয়ে অন্যায়কে সমর্থন করবেন না এবং অন্যায় কে দীর্ঘস্থায়ী করতে সহায়তা করবেন না।"
: মিথ্যে কিছু তো বলেনি, কিন্তু নির্বাচনের আগে না বললেই ভালো হতো। শোনো ঠান্ডা হও। ঐ ফেসবুক আর কয়জন দেখে। তুমি কাজ করেছো না? মানুষ এমনিতেই তোমাকে ভোট দেবে।
: আমার ইজ্জতের উপর নগ্ন হামলা, রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হুমকির মুখে, আর তুমি বলছো ঠান্ডা হবো।
: হুমমম ঠান্ডা থাকবে। না হলে মানুষ সত্য ভেবে আরো ছড়িয়ে দিবে।
: ওকে দ্রুত ঐসব ছাইপাশ ডিলিট করতে বলো, আর না করলে ওরে বাসা থেকে বের করে দিবো। নিজের মেয়ে যার জন্য এতো কিছু করছি, সে বলে আমি খারাপ। সে আমাকে ভোট দিতে না বলে!
:ওতো নেই, সকালে নাস্তা করেই আব্বার ওখানে চলে গেছে বলেছে নির্বাচন শেষ হলে আসবে।
: ও! এর সাথে তোমার বাবাও জড়িত! সব গুলারে দেখে নিবো। নির্বাচনের পরে চৌদ্দ শিকে ঢুকাবো।
: তুমি নিজের প্রতিবাদী মেযের দোষ আমার নিরীহ বাবার উপর চাপাচ্ছো কেন? বাবা এইসব কিচ্ছু জানে না। তোমার মেয়ে ইউনিভার্সিটি বন্ধুদের নিয়ে এইসব করছে।
: সব কয়টা হারামীর বাচ্চারে দেখে নিবো।
সুমিতা ফেসবুকে মানুষের কমেন্ট পড়ছে এবং দেখছে সবাই তার সাথে একমত। অনেকেই বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের মতো স্বাধীন দেশের নব্য দেশদ্রোহী রাজাকারদেরও ভোটে বয়কট করা উচিত।
বোস্টার ছাড়া একটা ভিডিও মেসেজ এতো তাড়াতাড়ি জড়িয়ে পড়তে পারে সুমিতা ভাবেনি। এলাকার অনেকেই লিখেছেন, এই ডিডিও বার্তাটি সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সহায়তা করবে। অনেকে বলেছে, মেয়ে যেখানে সৎ নিষ্ঠাবান এবং দেশ প্রমিক সেখানে বাবার এই ইতিহাস, নিজস্ব সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে।
: নানু ভাই কি করছো?
: এই ফেসবুক দেখছি।
: হুমমম আমিও দেখলাম এবং হঠাৎ নানু বাসায় আসার কারণও বুঝতে পারলাম।
: নানু ভাই, আমি শিক্ষিত সন্তান হয়ে, দেখে, শোনে, বুঝে যদি প্রতিবাদ না করি, তাহলে আমার এই শিক্ষার মূল্য কি?
: ঠিক বলেছি। সবার তোর মতো প্রতিবাদী হওয়া উচিত।
: তোর বাবা তো ভাববে, এই ভিডিওএর পেছনে আমার হাত আছে।
: ভাবুক। এই যে তুমি মুক্তিযোদ্ধা, অথচ ভিন্ন মতের রাজনীতি করো বলে তোমাকেও রাজাকার বলে। দেশদ্রোহী বলে। মামাদের রাজাকারের বাচ্চা বলে।
: বোনরে ক্ষমতার চশমা খুব খারাপ জিনিস, ক্ষমতার চশমা দিয়ে নিজেকে ছাড়া বাকি সবাইকে রাজাকার, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ মনে হয়। তোর বাবা যা করছে সেটা ঐ ক্ষমতার চশমার প্রভাব। তুই চিন্তা করিছ না। তোর কিচ্ছু হবে না।
: কি হবে আর কি হবে না, তা ভেবে তো পোস্ট করিনি। আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভোটাধিকার প্রয়োগে মানুষকে অনুরোধ করেছি মাত্র। এখন মানা না মানা পাবলিক এর কাজ। আমার দায়িত্ব পালন করেছি এখন পাবলিকের দায়িত্ব পালনের কাজ।
: নানু ভাই তোমার বাবা এবারও পাশ করবে এবং জনগণ আবারও ঠকবে।
: নানু ভাই, ভালো মানুষ গুলো যেন জয়ী হয়।
: আমিন। তুমি রেস্ট নাও আমি উঠছি।
কদম আলী নির্বাচন পরাজিত হয়। মেযের নেগেটিভ প্রচারণায় ভোট কমে যায়। বৌ এর সাথে রাগা রাগির এক পর্যায়ে বুকের ব্যাথায় ঢলে পরে। দ্রুত হাসপাতালে আনা হয়।
কদম আলী এখন আইসিসিউ (CCU) তে। বিমর্ষ দলীয় কর্মীরা হতাশ তবে দল জয়ী হওয়ায় কিছুটা স্বস্তিতে আছে।
৭২ ঘন্টা পাড় হয়েছে। কদম আলী এখন বিপদ মুক্ত এবং ক্যাবিনে আছেন। বৌ সোহাগী স্বামীর হাত ধরে আছেন। একটু একটু কথা বলেন। জ্ঞান ফিরেই একবার মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছেন।
কদম আলী চোখ মেলে তাকালেন। মেয়েকে খুঁজছেন। মেয়েকে দেখতে না পেয়ে স্ত্রী সোহাগীর চোখের দিকে তাকালেন।
: কিছু বলবে?
: আমার মেয়ে, আমার মা সুমিতা কোথায়?
: ও আছে, তিন ধরেই বারান্দায় বসে শুধু কান্না করছে। ভযে তোমার কাছে আসছে না।
: তুমি ওকে ডাকো। ওকে আমার বুকটা ছুঁতে বলো, আমার সব ব্যথা দূর হয়ে যাবে। আমি ভালো হয়ে যাবো।
সোহাগী হাত সরিয়ে নিয়ে উঠে এলেন, দরজা খোলে সুমিতাকে ডাকলেন। সুমিতা একটা ডাকের অপেক্ষায় যেন ছিলো। দৌড়ে গিয়ে বাবার পা জড়িয়ে ধরে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
: এই আমার প্রতিবাদী সাহসী মেয়ে কাঁদছিস কেন? আমার বুকে আয়। তুই ঠিক কাজটি করেছি, আমাকে পাপ কাজ থেকে ফিরে আসতে সাহায্য করেছিস। আমি আজ থেকে তোর স্বপ্নের মতো বাবা হয়ে বেঁচে থাকবো। আমি আমার মেয়ের মাঝে আগামী দিনের নেতৃত্ব দেখতে পারছি। পরবর্তী নির্বাচনে তুই হবি এই আসনের এমপি। আমি তোর প্রচারণায় কাজ করবো। তুই আমার জ্ঞানের চোখ খুলে দিযেছিস।
সুমিতা বাবার বুকে মাথা রেখে কাঁদছে, কদম আলী একহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছেন আর এক হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিচ্ছেন। পাশে দাঁড়িয়ে মা সোহাগী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আঁচলে চোখের জল মুছেন।
=================
তারিখঃ ২৫/১২/২০১৮
সময়ঃ ১২:৪৭ মিনিট
© ডি এম কামরুজ্জামান স্বাধীন
লেখকঃ বেসরকারি চাকরিজীবি ।
ডিসক্লেইমারঃ দয়া করে কেউ লেখাটার সাথে রাজনীতিকে জড়াবেন না। এই গল্পটা পুরোই কল্পনা প্রসূত, বাস্তবতার সাথে মিলে গেলে কাকতালিয়।
No comments:
Post a Comment