Tuesday, January 8, 2019

ছোটগল্প: তৃষিত স্বপ্ন

ছোট গল্প

 তৃষিত স্বপ্ন
✍মিনহাজউদ্দিন মন্ডল

তোমার তো পছন্দ জাম্বুরা! তা হঠাৎ এতো গুলো কমলা লেবু নিয়ে এলে?

স্ত্রী জমিলা স্বামী কাদের এর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন। কাদের সাহেব বিচক্ষণ লোক। বুদ্ধিমত্তার সহিত প্রতিটি কথার উত্তর দেবার চেষ্টা করেন। বৌ এর হঠাৎ এমন প্রশ্নের উত্তরেও বুদ্ধির ছাপ রাখার চেষ্টা করলেন এবং উত্তর দিলেন।

: জাম্বুরা তো আর কম খেলাম না! এখন কিছুদিন কমলা লেবু খেয়ে দেখি। ভাবতে পারো রেস্ট পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি।

: সব টেস্ট পরিবর্তননের চেষ্টা করো না আবার, তাহলে কিন্তু ঘরের কথা পরে জেনে যাবে।

: তোমার মাথায় তো সারাদিন একই কথা ঘুরপাক খায়। অন্য কিছু ভাববে কি করে?

:আমার পছন্দ সাগর কলা আর তুমি সব সময়ই নিয়ে আসো চম্পা কলা। নিজেরটাই সব সময় বোঝো। আমার পছন্দের দাম দিয়েছো কখনও?

: ওরে বাবা বিধাতার দেয়া রিজিক পছন্দ না করে উপায় আছে?

জমিলা কমোরে কাপড় পেচিয়ে বাজার নিয়ে রান্না ঘরে দিকে চলে গেলেন। কাদের সাহেব স্ত্রীর কাপড় পেচানো কমোরের দিকে তাকিয়ে ক্ষুধার্ত অনুভব করলেন।

: তাড়াতাড়ি করো, অনেক ক্ষুধা লেগেছে।

: খেতে গেলে একটুতেই যার হয়ে যায়, তার আবার ক্ষুধা লাগার কি আছে! (স্ত্রী জমিলা কিচেন থেকেই বিরক্তি নিয়ে উচ্চ স্বরে বললেন।)

কাদের সাহেব কয়েক বার এসে স্ত্রীকে দেখে গেলেন। জমিলা বেগম রান্না বান্না করছেন। স্বামীর ঘন ঘন কিচেনে আসাটা পছন্দ করছেন না। আবার যখন এলেন কিছুটা রাগ আর বিরক্তি নিয়ে বললেন-

: এতো ঘন ঘন কিচেনে আসার কি হলো? আমি তো আর এখানে আয়োজন করে বসে নেই।

:আহা রাগ করো কেন? শুক্রবার, বাসায় বসে আছি, তাই ক্ষুধাটা একটু বেশী।

: বেশী ক্ষুধা ভালো না। বয়স হয়েছে, ক্ষুধাকে নিয়ন্ত্রণ করো।

: কি বলো! চল্লিশ প্লাস কোন বয়স হলো? এই বয়সে ইংলিশ মুভিতে ছেলেরা নায়কের অভিনয় করে।

: ওরে আমার হিরো আলম। ইংলিশ মুভির নায়ক! ধরার আগে ক্ষয়ে পরে, তার আবার নায়ক হবার শখ!

: তুমি কিন্তু আক্রমণ করে কথা বলছো। একটু সংযত হও, ছেলে মেয়ে বাসায়!

: কেন চুপ থাকবো? ওরা বড় হয়েছে। এখন জানুক ওদের মা সারা জীবন কীভাবে বঞ্চিত হয়েছে।

মিঃ কাদের সাহেব এবার আর কিচেনের আশেপাশে এলেন না, সোজা রুমে ঢুকে খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন।

মেয়ে পল্লবী ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। উচা লম্বা আর স্বাস্থ্যের গঠনের কারণে সবাই বয়সের চেয়ে বড় মনে করেন। বাসায় প্রায়ই বিয়ের সমন্ধ আসে। মিঃ কাদের সাহেব এ নিয়ে আগ্রহ দেখালেও জমিলা বেগম আগ্রহী না। মা জমিলার কথা হলো লেখা পড়া শেষ করবে এরপর বিয়ে। পল্লবী মায়ের কথাতেই সায় দেয়।

কলেজে পল্লবী বেশ পরিচিত। সিনিয়র ভাইয়েরা একে ওকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠায়, ফোন নম্বর শেয়ার করে। ফেসবুক আই ডি চায়। বান্ধবীরাও এই নিয়ে পল্লবীকে একটু খোঁচায়। কেউ কেউ সিনিয়রদের হয়ে ওকালতি করে। খুব ক্লোজ বান্ধবী সোমা তো একদিন সজলের কথা বলেই ফেলে।

:পল্লবী সজল কতো স্মার্ট এবং সুদর্শন, তুই ওকে অনন্ত ভেবে দেখতে পারিছ।

: বন্ধু স্মার্ট আর সুদর্শন ব্যাপারটা বাহ্যিক, অন্তর্গত দিক তুই কতোটুকু জানিছ?

:ঠিক আছে, ওর সাথে মিশে সেটা বোঝার চেষ্টা কর।

:থাক, আজ কালকার ছেলেদের সাথে একটু মিশতে গেলেই রাতে ফেসবুকের ইনবক্সে গল্পের নামে আজাইরা কথা জুড়ে দেয়, এর মধ্যে এমন কিছু শব্দ থাকে যা ভদ্রতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।

:ইশ একটু ফান মজা দোষের কি?

:একটুও দোষের না। দোষটা হলো ফান এর চেয়ে লিটনের ফ্ল্যাটের গল্প বেশী হয়।

: তা যাই বলিছ, সজলকে তোর ফিরিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। ওর মতো ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

: আমার আব্বু কে দেখেছিস?

:হুমমম। আংকেল অনেক স্মার্ট ও সুদর্শন।

: কিন্তু আমার মায়ের কাছে সব সময়ই বাবা একজন অতিসাধারন। সারাক্ষণ মা জারীর উপর রাখে। এখন বড় হয়েছি তো মায়ের কথার মিনিং বুঝি। তাই সুদর্শন পাত্রের প্রতি আমার লোভ কম।

: কি বলিছ! আংকেল কি.... (লজ্জায় থেমে যায়)

: তোর থেমে যাওয়া প্রশ্নের মানি আমি বুঝেছি। মা হয়তো প্রত্যাশা অনুযায়ী তৃপ্ত না, বা চাওয়া পাওয়ার ব্যবধান বিস্তর। তাই  খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বাবাকে সব সময়ই অশান্তিতে রাখে।

: এটা আন্টি ঠিক করে না। আংকেল অনেক ভালো এবং কতো সুন্দর একটা মানুষ।

: আমি মাকে যতোটা বুঝেছি তাতে আমি সজলের চেয়ে আমাদের কলেজের সুঠাম দেহী সুমনকে বেশি পছন্দ করি।

: সুমন!! ঐ বডি বিল্ডার আর কালো ছেলেটা?

:হুমমম কালো ছেলেটা আমার পছন্দ

:তোর রুচী এতো বিচ্ছিরি আগে জানতাম না।

:এটা রুচীর ব্যপার না সুমী, এটা চাহিদা আর যোগানের সামঞ্জস্যের ব্যপার। সুদর্শন বয় যখন চাহিদার সাথে যোগান দিতে ব্যর্থ হবে তখন তুমি মানসিক রোগী হবে অথবা বিকল্প সাপোর্ট এর জন্য হন্যে হয়ে যাবে।

: তোর কথার আগা মাথা বুঝি না।

: বুঝবি একদিন বুঝবি, সেদিন আফসোস করে এই পল্লবীর কথা বলে কাঁদবি।

:ওতো বোঝার দরকার নেই। কালো পোলা আমার চলবে না।

: তাহলে সজলকে তুই প্রপোজ করে ফেল।

: আমি তোর মতো অতোটা আকর্ষণীয় হলে বসে থাকতাম না।

কাদের সাহেব রাতে খেয়ে শুয়ে আছেন। স্ত্রী জমিলার জন্য অপেক্ষা করছেন। জমিলা বেগম ড্রয়িং রুমে বসে টিভিতে ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখছেন।

কাদের সাহেব এপাশ ওপাশ করছেন। চোখে ঘুম আসছে না। স্ত্রীর সান্নিধ্য চাচ্ছেন। ছুটির রাত একটু রোমান্টিক হবার চেষ্টা করছেন।

ঠিক বারোটারও পরে জমিলা বেগম এসে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। কাদের সাহেব ঘুরে স্ত্রীর শরীরে হাত দিলেন। একটু আদর করার বাহনায় কাছে টানতে চাইলেন।

: খবরদার ধরবে না। আমার গরম না লাগতে লাগতে তোমার শীত লেগে যায়, এমন রোমান্টিক খেলা এখন আর উদ্বেলিত করে না। এর চেয়ে ঘুম দাও ভালো হবে।

: তুমি কিন্ত স্বামীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করছো, পাপ হচ্ছে 😭

: আর তোমার বুঝি খুব পুণ্য হয়। আমার অধিকার সম্পর্কে কি তোমার এই একুশ বছরেও ধারনা হয়নি?

: দেখো তুমি এই শেষ বিকেলে এসে রঙ্গিন দিনটার ললাটে কলংকের তীলক এঁকে দিচ্ছো ।

: তুমি কোন সকালে সুখের রঙ্গিন ফুল দিয়েছিলে?

: যতোটা পেরেছি উজার করে দিয়েছি। কোন কিছুর অপূর্ণতা তো রাখিনি।

:তোমরা ছেলেরা শুধু অর্থ, গাড়ি আর বাড়িতে পূর্ণতা খোঁজো। এর বাইরেও একটা চাহিদা আছে, সেটার দিকে নজর দাও না। সতের বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে, কিছু বোঝে উঠার আগেই পল্লবী কোলে এসেছে। এর চার বছর পর পল্লব এলো। এদের লালন পালন আর বড় করতে গিযে নিজের অনেক কিছুই বিসর্জন দিয়েছি। আজ ওরা বড়, নিজেদের কাজ নিজেরাই করতে পারে, আমার অবসর। বয়সতো মোটে পয়ত্রিশ। এই বয়সে এখন অনেকে এক বাচ্চার মা।

: জমিলা আমি তো কম করছি না। কোন কিছুতেই অপূর্ণতা রাখছি না। তোমাকে বিয়ে করেতো অযত্ন করিনি ।

: যত্ন কি বোঝার আগেই তো অন্যদের যত্নের ভার দিয়ে নাক ডেকে ঘুমানোর অভ্যাস করে ফেললে।

: তাই তো এখন আবার আদরে যত্ন করতে চাই।

: হা হাহাহা, এখন যত্ন মনে হয় না, যন্ত্রণা মনে হয়। এখন খেলা বুঝি তো! তোমার টি-টুয়েন্টি পছন্দ হলেও আমার একদিনের ম্যাচ পছন্দ।

কাদের সাহেব আবারও জমিলাকে পাশ ফেরাতে ব্যর্থ হলেন। বালিশ থেকে মাথা তোলে জমিলার মুখের দিকে তাকালেন। জমিলার গাল বেয়ে অশ্রু গলে পড়ছে। কাদের সাহেব হাত দিয়ে মুছে আলতু করে চুমু খেলেন। জমিলা মুহূর্তে অভিমান ভুলে সোজা হয়ে শুয়ে স্বামীকে বুকে টেনে নিলেন।

==================
তারিখঃ ০৮/০১/২০১৯
সময়ঃ ২০:০৬ মিনিট।

-------------------------------------
নোট: গল্পটা আমার কল্পনার শাব্দিক প্রকাশ। কারো সাথে মিলে গেলে আন্তরিক দুঃখিত। পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

No comments:

Post a Comment