Tuesday, December 24, 2019

ছোটগল্প : বাবা-মায়ের পরিচয় >> মিনহাজউদ্দিন মন্ডল

"একবার এক জুনিয়রের সাথে গল্প করতে করতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার বাবা কি করেন? 

ছেলেটা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো ... কেমন যেন দ্বিধা করছিলো বলতে ... এরপর মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বললো, আমার বাবা দিনমজুরের কাজ করে !!

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি এটা বলতে লজ্জা পাচ্ছো?

ছেলেটা বললো, জ্বী ভাই। লোকে তাচ্ছিল্য করে এটা শুনলে। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে জাজ করে। 

আমি খুব অবাক হলাম ... ছেলেটাকে বুঝালাম ... তোমার বাবা এত কষ্ট করে দিনমজুরের কাজ করেও তোমাকে এত বড় করেছেন, ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াচ্ছেন, মাসে মাসে টাকা পাঠাচ্ছেন এবং সেই টাকা দিয়ে তুমি এত স্মার্টলি চলতেছো ... সেই বাবার পরিচয় দিতে তোমার লজ্জা লাগবে কেন? ... তুমি মাথা উঁচু করে বলবা, তোমার বাবা একজন দিনমজুর এবং তার জন্যই তুমি এতদূর এসেছো !!

আরেকবার এক বন্ধু তার প্রেমিকার কাছে বাবার পেশা নিয়ে মিথ্যে বলেছিল ... কারণ তার বাবা কোন একটা প্রতিষ্ঠানের বেশ ছোট পোস্টে চাকরি করেন - এটা শুনলে তাদের বিয়ে ভেঙ্গে যাবে ... কি অদ্ভুত !!

আমাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো বোধহয় একটু পরিবর্তন করা দরকার ... ২০-৩০-৪০ বছর আগে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে আমাদের বাবা-মা ছিলেন, এটা আমাদের কল্পনার বাইরে ... অভাবের সংসারে অনেকে পড়াশুনার সুযোগ পায় নি ... অনেকের ভাগ্য সহায় হয় নি ... তখনকার সময়ে পড়াশুনা কিংবা ক্যারিয়ারের পথটা এতটা সহজ ছিল না ... আর্থিক সামর্থ্যও একটা বড় ইস্যু ছিল !! 

এত প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও যাদের বাবা-মা অ্যাকাডেমিক লাইফ এবং ক্যারিয়ারে শাইন করতে পেরেছেন, তাদের স্যালুট ... যারা পারেন নি, কিন্তু অনেক স্ট্রাগল করে তাদের ছেলেমেয়েদেরকে বড় করেছেন এবং করছেন, তাদের পেশার পরিচয় দিতে সমাজের তথাকথিত অ্যাপ্রুভালের ভয়ে আমাদের লজ্জা পেতে হবে কেন?

অভাবের সংসারের কারণে আমার বাবার পড়াশুনা বেশিদূর আগায় নি ... গ্রাম থেকে শহরে এসে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজে বছরের পর বছর ভয়াবহ কষ্ট করে গেছে সে ... বিয়ের পর ৩ হাজার টাকা ভাড়ার একটা বাসা নিয়ে ঢাকায় থাকা শুরু করে ... ছোটখাটো পোস্টের সেইসব চাকরি করে সীমিত ইনকাম দিয়ে আমাকে আর আমার বোনকে বড় করছে বাবা !!

বাবা অনেক কিছু বুঝে না ... বাবা ফাইনান্স বুঝে না, মার্কেটিং বুঝে না ... কিন্তু আমার রিসার্চের কাজে ১০ জন মানুষের ডাটা লাগতো, সেই ফর্ম বাবা পূরণ করে এনে দিছে আমাকে ... বাবা বুঝে না কিভাবে উবার কল করতে হয় ... এই বাবাই আমাকে রাস্তায় চলা শিখিয়েছে !! 

বাবা ফেইসবুক কিভাবে চালাতে হয় - অত ভালভাবে বুঝে না ... প্রায়ই এসে বলে, মেসেঞ্জারে অমুক কে কল দিবো কিভাবে একটু দেখায় দেও ... এই বাবার রক্ত পানি করা টাকা দিয়ে নেটের বিল দিয়ে দিয়ে আমি ফেইসবুকে এত লেখা লিখি গত ৬-৭ বছর ধরে !!

বাবার শিক্ষা, চাকরি কিংবা অন্যান্য দিক দিয়ে যে লিমিটেশন আছে, সেই পরিচয় দিতে 'লোকে কি বলবে' - এটা ভেবে আমার লজ্জা লাগবে কেন? ... 'অমুকের পরিবার মেনে নিবে না' - এই ভেবে বাবার পেশাকে লুকাতে হবে কেন? 

আমার আরো গর্ব হয় যে বাবা এত লিমিটেশন নিয়েও তিল তিল করে আমাকে বড় করছে ... আজকে আমার যত অ্যাচিভমেন্ট, যত ডিগ্রি, আমার যা পরিচয় - সবকিছু আমার বাবার জন্য ... সেই বাবা দিনমজুর হোক, পিয়ন হোক, কৃষক হোক কিংবা যা খুশি হোক - সেই পরিচয়ে আমার কিংবা যে কোন সন্তানের গর্ব হওয়া উচিত !!

আমি আমার শিক্ষাজীবন কিংবা আমার ক্যারিয়ারে যত উঁচুতে উঠি, আমার কাছে আমার বাবার অবস্থান তার চেয়েও বেশি উঁচুতে ... দিনশেষে আমরা যতই স্মার্ট হই, আর আমাদের বাবা-মা যতই তথাকথিত 'আনস্মার্ট' হয়ে থাকুক, তাদের পরিচয় দিতে গিয়ে কখনোই যেন মনে দ্বিধা কিংবা লজ্জা না আসে !!

গর্বের সাথে বাবা-মায়ের পরিচয় দিতে সমাজের মানুষের তথাকথিত স্বীকৃতির কোন প্রয়োজন নেই !!" 🙂

No comments:

Post a Comment